ফরিদগঞ্জ ১০:০১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
চরদুঃখিয়া পশ্চিম ইউনিয়নে মহিলা সমাবেশ ফরিদগঞ্জে বিএনপির প্রার্থী বদলের দাবিতে এবার মহিলা দলের মানববন্ধন পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ফরিদগঞ্জে বিএনপি কর্মীদের টানা সড়ক অবরোধ মনোনয়ন বিতর্কে উত্তপ্ত ফরিদগঞ্জ, এনডিপির প্রেস ব্রিফিংয়ে তোলপাড় ফরিদগঞ্জ রাজনীতি ‘আমি রোহিঙ্গা হয়ে আসিনি, ফরিদগঞ্জেই আমার জন্ম’ – লায়ন হারুনুর রশিদ চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনে বিএনপির নেতৃত্ব সংকট ঘিরে অরাজকতা—এনডিপি চেয়ারম্যানের তীব্র সমালোচনা ফরিদগঞ্জে মাদক মামলা সাক্ষী হওয়ার খেসারত দিতে হলো এক যুবককে ইসলামী ব্যাংকে একচ্চত্র ও অবৈধ নিয়োগ বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ বিমানবন্দর থেকে ফরিদগঞ্জ উপজেলা যুবলীগ আহ্বায়ক গ্রেপ্তার শিক্ষার্থী নেই, কার্যক্রম বন্ধ, তবু চলছে মাদ্রাসার নামে চাঁদা সংগ্রহ

লাইফ জেনারেল’ নাকি ‘ডেথ জেনারেল’?

শামীম হাসান
  • আপডেট সময় : ০৯:২২:১৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১ অগাস্ট ২০২৫ ৮৫১ বার পড়া হয়েছে

 

২৩ বছর বয়সী গৃহবধূ ফারিয়া আক্তার। দ্বিতীয়  সন্তানের মুখ দেখার স্বপ্ন নিয়ে তিনি নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ফরিদগঞ্জের লাইফ জেনারেল হাসপাতালের গাইনী চিকিৎসক ডা. নুসরাত জাহান বিন্তীর কাছে। গর্ভধারণের শুরু থেকে প্রসবের আগপর্যন্ত প্রায় নয় মাস ধরে ছিলেন ওই চিকিৎসকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে।

২০২৫ সালের ২০ জুলাই। সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য ফারিয়াকে নেওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে (ওটি)। কিছুক্ষণ পর ফারিয়ার শ্বশুরকে ওটিতে ডেকে বলা হয় “জরায়ুতে টিউমার পাওয়া গেছে, দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান।”

হতবাক পরিবার সময় নষ্ট না করে দ্রুত ফারিয়াকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক)। সেখানে জরুরী অপারেশনে নবজাতক শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও, ২৩ জুলাই বিকেলে ফারিয়ার মৃত্যু হয়।

ঢাকা মেডিকেলের মৃত্যুসনদে বলা হয়, Placenta Increta জনিত জটিলতায় সেপটিক শক ও হাইপোভোলেমিক শকে মৃত্যু হয়েছে ফারিয়ার।

গর্ভাবস্থায় ফারিয়া অন্তত ১৫-১৬ বার আল্ট্রাসনোগ্রাফি করান। অথচ চিকিৎসক হিসেবে ডা. বিন্তী বুঝতে পারেননি প্লাসেন্টা ইনক্রেটার মতো ভয়ংকর জটিলতা।

চিকিৎসকদের মতে, এটি এমন এক অবস্থা যেখানে গর্ভফুল (প্লাসেন্টা) অস্বাভাবিকভাবে জরায়ুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়।
এই রোগ সাধারণত ১৬-১৮ সপ্তাহেই আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে ধরা পড়ার কথা।

চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. নুর আলম বলেন, “আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে প্লাসেন্টার অবস্থান বোঝা যায়। রোগীকে সঠিক সময়ে রেফার করা হলে এমন মৃত্যু এড়ানো সম্ভব ছিল।”

ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর ফারিয়ার পরপর তিনটি অপারেশন করতে হয় প্রথমে নবজাতককে বের করা হয়, দ্বিতীয় অপারেশনে গর্ভফুল আলাদা করা হয়, তৃতীয় অপারেশনে জরায়ু কেটে ফেলা হয়। এরপরও রক্ষা করা যায়নি ফারিয়ার জীবন।২৩ জুলাই বিকেলে মৃত্যু হয় তরুণ এই মায়ের।

ফারিয়ার শ্বশুর মাহবুবুল আলম বলেন,
তিন কক্ষ পেরিয়ে ওটিতে গেছি, সবখানে ছিল রক্ত। ডাক্তার বললেন টিউমার, অথচ ঢাকায় গিয়ে জানলাম কিছুই ছিল না। দায় তো কেউ নিচ্ছে না! তিনি আরও জানান, ফারিয়া ওটি রুমে হেঁটে গিয়েছিলো। কয়েক মিনিট পরই বলা হয় তার পেটে টিউমার, দ্রুত ঢাকায় নিতে হবে। অথচ ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা জানান, টিউমার নয়, আপনারা ভাগ্যবান—শিশুটা বেঁচে গেছে।

এদিকে চিকিৎসকের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, ডা. বিন্তীর প্রেসক্রিপশন ও চেম্বারের কার্ডে লেখা রয়েছে এফসিএস শেষপর্ব (গাইনি ও অবস) তবে জানা যায়, তিনি এখনও পরীক্ষার্থী। এবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,এভাবে লেখায় সমস্যা নেই। পড়ালেখা চলাকালীন এমন লেখা যায়।”

ফারিয়ার পরিবারের অভিযোগ, অপারেশন থিয়েটার ছিল রক্তে ভেজা ও অপরিচ্ছন্ন রোগীকে সময়মতো রেফার না করে ভুল তথ্য দিয়ে সময়ক্ষেপণ করা হয়

লাইফ জেনারেল হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. পরেশ চন্দ্র বলেন,সব সময় আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে ইনক্রেটা ধরা পড়ে না। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মন্তব্য দায়িত্ব এড়ানোর নামান্তর।

ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন, “জরায়ুর বাইরে কখনোই গর্ভফুল থাকে না। প্লাসেন্টা দেখতে হলে জরায়ুর দেওয়াল কেটেই দেখতে হয়। জরায়ু না কেটে প্লাসেন্টা দেখা—এ দাবি চিকিৎসা নীতির পরিপন্থী।

চাঁদপুর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। সিভিল সার্জন ডা. নুর আলম বলেন, গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এদিকে, বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই হাসপাতাল বয়কটের ডাক দিয়েছেন৷ চিকিৎসকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন সাধারণ মানুষ।

ফারিয়ার স্বপ্ন ছিল নতুন জীবনের, নতুন সন্তানের মুখ দেখার। সেই সন্তান বেঁচে আছে—কিন্তু মা নেই।

এই হাসপাতালে পূর্বেও ভূল চিকিৎসায় একাধিক রোগীর মৃত্যুর ঘটনার অভিযোগ রয়েছে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

লাইফ জেনারেল’ নাকি ‘ডেথ জেনারেল’?

আপডেট সময় : ০৯:২২:১৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১ অগাস্ট ২০২৫

 

২৩ বছর বয়সী গৃহবধূ ফারিয়া আক্তার। দ্বিতীয়  সন্তানের মুখ দেখার স্বপ্ন নিয়ে তিনি নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ফরিদগঞ্জের লাইফ জেনারেল হাসপাতালের গাইনী চিকিৎসক ডা. নুসরাত জাহান বিন্তীর কাছে। গর্ভধারণের শুরু থেকে প্রসবের আগপর্যন্ত প্রায় নয় মাস ধরে ছিলেন ওই চিকিৎসকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে।

২০২৫ সালের ২০ জুলাই। সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য ফারিয়াকে নেওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে (ওটি)। কিছুক্ষণ পর ফারিয়ার শ্বশুরকে ওটিতে ডেকে বলা হয় “জরায়ুতে টিউমার পাওয়া গেছে, দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান।”

হতবাক পরিবার সময় নষ্ট না করে দ্রুত ফারিয়াকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক)। সেখানে জরুরী অপারেশনে নবজাতক শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও, ২৩ জুলাই বিকেলে ফারিয়ার মৃত্যু হয়।

ঢাকা মেডিকেলের মৃত্যুসনদে বলা হয়, Placenta Increta জনিত জটিলতায় সেপটিক শক ও হাইপোভোলেমিক শকে মৃত্যু হয়েছে ফারিয়ার।

গর্ভাবস্থায় ফারিয়া অন্তত ১৫-১৬ বার আল্ট্রাসনোগ্রাফি করান। অথচ চিকিৎসক হিসেবে ডা. বিন্তী বুঝতে পারেননি প্লাসেন্টা ইনক্রেটার মতো ভয়ংকর জটিলতা।

চিকিৎসকদের মতে, এটি এমন এক অবস্থা যেখানে গর্ভফুল (প্লাসেন্টা) অস্বাভাবিকভাবে জরায়ুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়।
এই রোগ সাধারণত ১৬-১৮ সপ্তাহেই আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে ধরা পড়ার কথা।

চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. নুর আলম বলেন, “আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে প্লাসেন্টার অবস্থান বোঝা যায়। রোগীকে সঠিক সময়ে রেফার করা হলে এমন মৃত্যু এড়ানো সম্ভব ছিল।”

ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর ফারিয়ার পরপর তিনটি অপারেশন করতে হয় প্রথমে নবজাতককে বের করা হয়, দ্বিতীয় অপারেশনে গর্ভফুল আলাদা করা হয়, তৃতীয় অপারেশনে জরায়ু কেটে ফেলা হয়। এরপরও রক্ষা করা যায়নি ফারিয়ার জীবন।২৩ জুলাই বিকেলে মৃত্যু হয় তরুণ এই মায়ের।

ফারিয়ার শ্বশুর মাহবুবুল আলম বলেন,
তিন কক্ষ পেরিয়ে ওটিতে গেছি, সবখানে ছিল রক্ত। ডাক্তার বললেন টিউমার, অথচ ঢাকায় গিয়ে জানলাম কিছুই ছিল না। দায় তো কেউ নিচ্ছে না! তিনি আরও জানান, ফারিয়া ওটি রুমে হেঁটে গিয়েছিলো। কয়েক মিনিট পরই বলা হয় তার পেটে টিউমার, দ্রুত ঢাকায় নিতে হবে। অথচ ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা জানান, টিউমার নয়, আপনারা ভাগ্যবান—শিশুটা বেঁচে গেছে।

এদিকে চিকিৎসকের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, ডা. বিন্তীর প্রেসক্রিপশন ও চেম্বারের কার্ডে লেখা রয়েছে এফসিএস শেষপর্ব (গাইনি ও অবস) তবে জানা যায়, তিনি এখনও পরীক্ষার্থী। এবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,এভাবে লেখায় সমস্যা নেই। পড়ালেখা চলাকালীন এমন লেখা যায়।”

ফারিয়ার পরিবারের অভিযোগ, অপারেশন থিয়েটার ছিল রক্তে ভেজা ও অপরিচ্ছন্ন রোগীকে সময়মতো রেফার না করে ভুল তথ্য দিয়ে সময়ক্ষেপণ করা হয়

লাইফ জেনারেল হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. পরেশ চন্দ্র বলেন,সব সময় আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে ইনক্রেটা ধরা পড়ে না। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মন্তব্য দায়িত্ব এড়ানোর নামান্তর।

ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন, “জরায়ুর বাইরে কখনোই গর্ভফুল থাকে না। প্লাসেন্টা দেখতে হলে জরায়ুর দেওয়াল কেটেই দেখতে হয়। জরায়ু না কেটে প্লাসেন্টা দেখা—এ দাবি চিকিৎসা নীতির পরিপন্থী।

চাঁদপুর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। সিভিল সার্জন ডা. নুর আলম বলেন, গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এদিকে, বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই হাসপাতাল বয়কটের ডাক দিয়েছেন৷ চিকিৎসকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন সাধারণ মানুষ।

ফারিয়ার স্বপ্ন ছিল নতুন জীবনের, নতুন সন্তানের মুখ দেখার। সেই সন্তান বেঁচে আছে—কিন্তু মা নেই।

এই হাসপাতালে পূর্বেও ভূল চিকিৎসায় একাধিক রোগীর মৃত্যুর ঘটনার অভিযোগ রয়েছে।